প্রিজনভ্যানের সামান্যটুকু ছিদ্র দিয়ে পরিবারের সদস্যদেরকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে কোর্ট থেকে হাজিরা দিয়ে বিদায় নিলাম। সর্বোচ্চ ১৫ জনের প্রিজনভ্যানের গাড়িতে তখন আমরা ঠাসাঠাসি করে ৫৪ জন বন্দী। মাথার ঘাম আর চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। পাশেই একজন বলছিলো আমার ঈদ হবে যেদিন আমি জামিনে মুক্ত হবো। সাথে সাথে আরেকজন অভিজ্ঞ বন্দী কিছুটা আশ্বাসের সুর ছড়িয়ে বলতে থাকলেন যে ভাই, জেলখানায় ঈদের খাবার দাবার কিন্তু একেবারে খারাপ না। অন্য জনের বিক্ষুব্ধ মনোভাব- রাখেন আপনার খাবার দাবার! পরিবেশ খুব একটা ইতিবাচক মনে হলো না। পকেট থেকে পরিবারের সদস্যদের দেয়া তিনটা চিঠি বের করলাম পরপর। একহাতে গাড়ির গ্রিল শক্ত করে ধরে আরেক হাতে ঈদের চিঠিগুলো পড়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগলাম। চিঠিতে চোখ বুলালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে হয়। আবার পড়ে গেলে অন্যের শরীরে লাগলে তীব্র প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়। আরে ভাই দাঁড়িয়েই থাকতে পারছি না, আপনি আবার কি এক কাগজ পড়ায় ব্যস্ত। শক্ত হয়ে দাঁড়ান দুই হাতে গাড়ির গ্রিল ধরুন। ফাঁকে মায়ের চিঠির শুধু শিরোনামটা পড়তে পারলাম। আমার প্রিয় খোকন সোনা, আর বাকি লাইনগুলো পড়ার জন্য নিজেকে শক্ত করেও ধরে রাখতে পারিনি। চোখের পানি যেনো কোন বাঁধই মানতে চায় না। চোখ ঝাপসা হয়ে যেতেই আবার একজন দরদভরা কণ্ঠ নিয়ে মাথায় হাত বুলালেন। ভাই কি করবেন! আপনারা শিক্ষিত মানুষ। সবই তো বুঝেন। আপনাদের আবার দুঃখ কিসের! যে পথ আপনারা বেছে নিয়েছেন তাতো খুউব একটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। ধৈর্য ধরুন। আপনারাই জিতবেন। আবেগের মুহূর্তে কেউ সান্ত্বনা দিতে চাইলে আমার চোখের পানি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। হয়েছেও তাই। কান্না যতটাই না চেপে রাখতে চাই ঠিক ততটাই প্রকাশিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অন্যান্য দিনের মতো আজকেও গাড়িতে পরিচিত বন্দীদের সংখ্যাই বেশি। যে চোখের পানি আমার কাছে অসম্ভব আবেগের সেই পানিই আমার পরিচিত জনদের কাছে মারাত্মক দুর্বলতার। তাই আবেগকে প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমার পরিচিত জনরা তাদের মাসুদ ভাইকে দুর্বল দেখতে চায় না। তা আমি খুউব ভালো করে বুঝতে পারি। তাই নিজের প্রয়োজনকে নির্মমভাবে গলাটিপে হত্যা করে পরিচিত জনদের প্রয়োজনটাকেই সমাদৃত করলাম- চোখের পানিকে মুহূর্তেই হাসিতে পরিণত করে। মনে পড়লো সময়ের বিশ্বখ্যাত এক সাহিত্যেকের লেখা একটি উক্তি ‘পৃথিবী নাট্যমঞ্চ আমরা সেখানের এক একজন বড় বড় অভিনেতা’। এই সমস্ত অভিনয়ই মহান মাবুদের একটু সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। রক্ত, ঘাম আর চোখের পানির সম্মিলিত ফসল যদি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরিতে সামান্যতম ভূমিকাও রাখতে পারে তাতে ঈদের চেয়েই বা আনন্দ কম কিসের! এটা অন্য রকম আনন্দ। সে আনন্দ প্রকাশের ভাষা আমি শিখতে পারিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্যের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পরও। ওটা অপ্রকাশিত আনন্দ কিন্তু অসম্ভব উপলব্ধি এবং উপভোগের। প্রিজনভ্যান জেল গেটে পৌঁছতেই হুড়োহুড়ি করে নামার প্রতিযোগিতা, যেনো আমরা আমাদের বাসায় পৌঁছে গেছি। একটু স্বাচ্ছ্যন্দে নামার জন্য একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। যদিও পরিচিত জনদের একটা বিরাট সম্মান দেখানোর চেষ্টা লক্ষ্য করি, ভাই আপনি আগে নামুন। তবুও তাদেরই আগে নামার সুযোগ করে দিয়ে আত্মতৃপ্তি নিতে ভালো লাগে। জেলখানার মূল ফটকে তল্লাশির একপর্যায়ে ব্যাগের ভেতর লক্ষ্য করলাম দুটো গোলাপের সাথে দুটো ঈদ কার্ড একটা কার্ডে ছোট করে লেখা- বাবা, তুমি মিটিং শেষে বাসায় ফিরলেই সেদিন আমাদের ঈদ। কাঠ পেন্সিলের লেখা। ঘষা মাজাও হয়েছে বেশ কয়েকবার। নামিরা মামণি তখনো জানে যে আমি মিটিংয়ে আছি। মিটিং শেষ হলেই বাসায় ফিরবো। কারণ সুবিধা ছিলো কারাগারে যাওয়ার আগে থেকেই বাসায় খুউব কমই থাকা হতো। তখন থেকেই সে অভ্যস্ত যে বাবার মিটিং একটু লম্বা। কারারক্ষী তল্লাশির একপর্যায় কার্ড দুটো দিতে উদ্যত হলে, পাশের আরেকজন কারারক্ষীই তাকে বললেন অসুবিধা নাই স্যারকে বলে দিয়ে দিন। নিষিদ্ধ কিছু তো আর না। প্রথম কারারক্ষী কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেই বললেন চাকরিটা হারাতে চান? পারলে আপনি স্যারের কাছে নিয়ে যান। ঠিক আছে আমাকে দিন বলে কারারক্ষী হাতে নিয়ে কার্ড দুটো ভালো করে দেখে লেখাটা পড়ার চেষ্টা করলো। কবিতার কয়েকটি লাইন।
“কোথায় ঈদের চাঁদ কোথায় ঈদের দিন
মন ছুটে যায় ঐ মিসর ফিলিস্তিন,
ঘরে ঘরে লাশের মিছিল কাঁদার মানুষ নাই,
বলতে পারো কেমন করে ঈদের গজল গাই?
জুলুম শোষণ অত্যাচার শেষ হবে যে দিন
ঈদের খুশি আসবে ফিরে ঈদ হবে সে দিন॥
নিচে ছোট করে লেখা- তোমার অপেক্ষায় আমি। কারারক্ষী দু’জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে কি বুঝলো-বুঝতে পারলাম না কার্ড দুটো আমার হাতে দিয়ে দিলো। বিলম্ব না করে রুমে চলে গেলাম। ঈদ কার্ডটি হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। জামা-কাপড় খুলে একটু ফ্রেশ হওয়ারও শক্তি যেনো হারিয়ে ফেললাম। “তোমারই আমি” প্রেরকের কার্ডটা হাতে নিয়ে কার্ডের বিপরীত পাশে লেখা কবিতার কয়েকটি লাইনে চোখ বুলালাম”
ঈদের খুশি কোথায় গেল কোথায় ঈদের চাঁদ
চতুর্দিকে ছড়িয়ে যেন ক্লান্তি অবসাদ।
জালিম শাহির কয়েদখানায় ঈদের হেলাল বন্দী
কালোর সঙ্গে আলোর কভু হয় না তো ভাই সন্ধি।
আঁধার এবং আলোর মাঝে চলছে তুমুল যুদ্ধ,
চাঁদ সেতারা কার ইশারায় বিনা দোষেই রুদ্ধ?
নতুন জামা নতুন টুপি আতর আতর গন্ধ,
সবই আছে তবু যেনো স্তব্ধ খুশির ছন্দ
ভাঙতে হবে জেলের তালা আনতে হবেই চাঁদ
চলতে পথে দলতে হবেই পাহাড় সমান বাঁধ।
কবিতার লাইনগুলো পড়ে মনে হলো আমি নতুন শক্তিতে বলীয়ান মুক্ত আকাশের একজন মুক্ত মানুষ। মনে হলো তোমারই আমি” নামের যিনি প্রেরক তিনি আমার মনের অবস্থাটাকে সামনে রেখেই কবিতাটা বাছাই করেছেন। এই তোমারই “আমি” নামক প্রেরক মানুষটা আমাকে বরাবরই শক্ত রাখতে এবং শক্ত থাকতে কখনো কবিতা- কখনো ইসলামের ইতিহাস-কখনো কোরআন হাদিস কখনো বা দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীদের ত্যাগ-কোরবানির বর্ণনা তুলে ধরে সাহস জুগিয়েছেন নিরন্তর। সেই সাহসে ভর করেই আবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ঈদের উপহারগুলো সব ব্যাগ থেকে বের করে সুন্দর করে সাজিয়ে ভালোভাবে দেখলাম, মনেই হলো না যে আমি কারাগারে। পাঞ্জাবি পেলাম প্রায় ১০টার মতো। ভিতর থেকেই পেলাম ৫টা, পরিচিত জনরা ভেতরের কিছুটা অসচ্ছল-অসহায় প্রকৃতির বন্দী ভাইদের জন্য আরো বেশ কিছু পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গি দিয়েছেন।
অসম্ভব আনন্দ নিয়ে সব উপহার প্রয়োজনীয় উপযুক্ত ভাইদের হাতে পৌঁছে দিয়ে ঈদের জামাতের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
বৃষ্টি হলে ভবনের ভেতরে আর না হলে খোলা মাঠে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হবে বলে জানলাম। কারাগারে জীবনের প্রথম জামায়াতে অংশগ্রহণ উপলব্ধি আর অনুভূতিটা একেবারেই আলাদা। সাথে অতিরিক্ত আনন্দ যোগ হলো আমিরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া যাবে। সুযোগের সাথে নানান আইনি সীমাবদ্ধতার শঙ্কাও যে একেবারেই ছিলো না তা না। আলহামদুলিল্লাহ- সকাল ৯টার জামায়াতের জন্য সকাল ৭টা থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ভবনের গেটে অপেক্ষা করতে করতে আমাদের অনেক ভাই একসাথে জটলা হয়ে গেলেন। একজন কারারক্ষী আমাকে খানিকটা সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে কাছে এসে বললেন- বুঝতে পেরেছি কার জন্য অপেক্ষা করছেন, স্যারকে তো একেবারে শেষে নিয়ে আসা হবে। আর ওনার জন্য সামনের কাতারে জায়গা রাখা আছে ঠিক ইমামের পেছনে, এরই মধ্যে হঠাৎ একজন ডেপুটি জেলার, বেশ কয়েকজন কারা কর্মকর্তাসহ আমিরে জামায়াতকে বের হয়ে আসতে দেখলাম। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি আর কালো ফ্রেমের চশমার সাথে অভিজাত টুপি পরা একজন আল্লাহর দ্বীনের অকুতোভয় সৈনিকের মতো হেঁটে আসতে দেখে নিজের চোখকে সামলাতে পারলাম না, চোখের পানি মুছতে মুছতে সব বাধা অতিক্রম করে আমিরে জামায়াতের দিকে এগিয়ে যেতেই আমিরে জামায়াত খানিকটা হাত বাড়িয়ে আমাকে ওনার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। কান্নার পানির সাথে শব্দটাও কোনোভাবেই আর ঢেকে রাখতে পারলামন না। শরীরের সেই পুরনো ঘ্রাণ আর পরিচিত স্পর্শ। লেগেই থাকতে চাইলাম আমিরে জামায়াতের বুকের সাথে, আমিরে জামায়াতের দৃঢ়কণ্ঠ-কেমন আছো? এই-প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য বুকের কাছ থেকে মাথাটা তুলে ওনার মুখের দিকে তাকালাম লক্ষ্য করলাম- আমিরে জামায়াত চশমার নিচের ফাঁক দিয়ে আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছছেন। বুঝতে বাকি রইলো না- স্নেহের পরিমাণটা কোন মাত্রার। আমার চোখের পানি যেনো আর কোনোভাবেই বাঁধ মানতে চাইছে না, আমিরে জামায়াত আমার মুখটা তুলে কপালে চুমু খেলেন আমি মুহূর্র্তেই যেনো শিশু বনে চলে গেলাম। কান্নার চাপা শব্দটা অনেক স্পষ্ট হয়ে গেলো। চোখে কান্না আর মুখে আনন্দের বন্যা। ৪৪ দিনের রিমান্ডের সব যন্ত্রণা যেন মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেলো। আমিরে জামায়াত আমার হাতের আঙুলগুলো টিপে টিপে জিজ্ঞেস করলেন সব ঠিক আছে তো তোমার? এই প্রশ্নের সময় লক্ষ্য করলাম দৃঢ় কণ্ঠের অধিকারী আমিরে জামায়াতের কণ্ঠটা খানিকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। কারা কর্মকর্তারা আর সময় নিতে চাইলেন না। তারা অনুরোধ করলেন আমিরে জামায়াতকে স্যার সামনে চলুন। আমিরে জামায়াত আমাকে তার শরীর থেকে আলাদা করতে করতে শুধু বললেন ফি-আমানিল্লাহ। সবর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাহায্য করবেন। ইনশাআল্লাহ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক